পাইপলাইনে জমা পাঁচ লাখ কোটি টাকা

হামিদ-উজ-জামান: চারদিকে যখন ডলার সংকটে হাহাকার চলছে, সেই সময়ে পাইপলাইনে জমেছে বৈদেশিক অর্থের পাহাড়। ইআরডির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এখন জমা আছে ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০০ টাকা ধরে) প্রায় ৫ লাখ ৩ হাজার ৪০০ কোটি কোটি টাকা।

শর্ত না বুঝে ও নানা ধরনের ত্রুটিসহ বৈদেশিক ঋণের চুক্তি স্বাক্ষর, প্রকল্প তৈরি, অনুমোদন এবং তদারকির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ন ও দুর্নীতি, উন্নয়ন সহযোগীদের আমলাতান্ত্রিকতাসহ নানা কারণে বৈদেশিক অর্থছাড় কম হয়-এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডি সচিব শরিফা খান বলেন, আমাদের বৈদেশিক অর্থের পাইপলাইন বাড়ছে। সেই সঙ্গে অর্থছাড়ও (খরচ) বাড়ছে। তবে আরও বেশি অর্থছাড় বাড়ানো প্রয়োজন। তাহলে এই সংকটময় মুহূর্তে পুরোপুরি না হলেও ডলারের কিছুটা জোগান বাড়ত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আইএমএফ পাইপলাইনের অর্থ খরচ বাড়ানোর তাগাদা দিয়েছে। আশা করছি আগামী দিনে অর্থছাড়ের অঙ্ক বাড়বে।

সার্বিকভাবে সব ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির বেশ কিছু কারণ নির্ণয় করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এগুলো হলো-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব অন্যতম। এছাড়া আছে যেনতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা।

পাশাপাশি রয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি প্রভৃতি। এছাড়া বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের সময়ক্ষেপণকেও দায়ী করা হয়েছে। আরও আছে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না হতেই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া। এক্ষেত্রে আইএমইডি বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না হয়ে সাধারণত প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় না। কিন্তু চীন, ভারত এবং সরবরাহকারী ঋণের কিছু প্রকল্পে ছাড় দেওয়া হয়। যার বেশির ভাগই যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তীকালে ঋণ চুক্তির পর আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদন দিলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ অনেক বাড়াতে হয়েছিল।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পাইপলাইনের অর্থব্যয় বাড়ানো এ সময়ে অত্যন্ত জরুরি। কেননা ডলার সংকট মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের গতি বাড়ালে দুইদিকে লাভ হবে। অর্থাৎ দেশে কিছু ডলার আসবে এবং এই ব্যয়ের কারণে মূল্যস্ফীতিতে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলবে না।

সম্প্রতি ইআরডি আয়োজিত এক সেমিনারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, চুক্তির শর্ত না বুঝে ইআরডির কর্মকর্তরা চুক্তিতে সই করেন। এতে পরবর্তীকালে অনেক ঋণ গলার ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু করার কিছুই থাকে না। মামলা করলে দেখা যাবে যারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, তাদের জেলে ঢুকতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা ঠিকমতো ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) না পড়েই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন। এতে পরে ব্যয় ও সময় বাড়াতে হয়। প্রকল্পের বেশি ব্যয় ধরা হয়। এটা একধরনের ডাকাতি। এগুলো বন্ধ করতে হবে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী পাইপলাইনে জমা পড়েছে ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রকল্প ঋণ বা বাজেট সহায়তা হিসাবে আছে ৫০ দশমিক ২১ বিলিয়র ডলার। খাদ্য সহায়তা হিসাবে রয়েছে ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। শুরু থেকে প্রায় ১৬ হাজার ১২৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ঋণ ১২ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার এবং অনুদান হচ্ছে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। এই প্রতিশ্রুত অর্থের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে অর্থছাড় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ১৩৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে ঋণ রয়েছে ৭ হাজার ২৮৪ কোটি ডলার এবং অনুদান ২ হাজার ৮৫১ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ বাড়ছে বাংলাদেশের। তবে তা এখনো গ্রহণসীমার মধ্যেই আছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যেতে পারে। তবে এখন ঋণ নেওয়া হচ্ছে জিডিপির ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়া রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের হিসাবে ঋণ নেওয়া যেতে পারে ১৮০ শতাংশ। সেখানে নেওয়া হচ্ছে ৮৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয়ের ১৫ শতাংশ ঋণ নেওয়া গেলেও বাংলাদেশ নিচ্ছে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, সক্ষমতার অনেক কম বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছরে ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। এই ঋণ পরিশোধেরও চাপ বাড়বে আগামী দিনে। তবে এখনো স্বল্প সুদের ঋণ বেশি পাচ্ছে বাংলাদেশ। মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ হলো ফিক্সড রেটের বা স্বল্প সুদের ঋণ।

এছাড়া ফ্লটিং রেট বা কিছুটা অনমনীয় ঋণ ২৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। এগুলোর গড় সুদের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। গড়ে ২৮ বছরে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হবে। গড় রেয়াতকাল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ঋণ মাত্র ৪০ শতাংশ আর বহুপাক্ষিক ঋণ ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক (আইডিএ) থেকে ৩২ শতাংশ, এডিবি থেকে ২৪ শতাংশ, জাপান থেকে ১৮ শতাংশ, চীনের ৮ শতাংশ, রাশিয়ার ৫ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ, আইডিবি ও এআইআইবির ১ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ শতাংশ ঋণ। মোট গ্রহণ করা ঋণের মধ্যে এসডিআরে নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৪১ শতাংশ ঋণ। এরপরই রয়েছে মার্কিন ডলারে ৩২ শতাংশ, জাপানি ইয়েনে ১৮ শতাংশ, ইউরোয় ৩ শতাংশ এবং অন্যান মুদ্রায় ৬ শতাংশ ঋণ নেওয়া হচ্ছে।

সূত্র: যুগান্তর

আরো পড়ুনঃ